শবেবরাত বার্তা

image

শবেবরাত
আত-তাহরীক ডেস্ক
আরবী শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত
রাতকে উপমহাদেশে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। যা
‘সৌভাগ্য রজনী’ হিসাবে পালিত হয়।
ধর্মীয় ভিত্তি :
মোটামুটি ৩টি ধর্মীয় আক্বীদাই এর ভিত্তি
হিসাবে কাজ করে থাকে। (১) এ রাতে কুরআন
নাযিল হয় এবং এ রাতে আগামী এক বছরের
জন্য বান্দার ভালমন্দ তাক্বদীর নির্ধারিত
হয়। (২) এ রাতে বান্দার গোনাহ সমূহ মাফ করা
হয়। (৩) এ রাতে রূহগুলি সব ছাড়া পেয়ে
মর্ত্যে নেমে আসে। ফলে মোমবাতি, আগরবাতি,
পটকা ও আতশবাযী হয়তোবা রূহগুলিকে সাদর
অভ্যর্থনা জানাবার জন্য করা হয়।
শবেবরাতে হালুয়া-রুটি খাওয়া সম্পর্কে বলা
হয়ে থাকে যে, এ দিন আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর
দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল।
ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-
রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায়
সমব্যথী হয়ে হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ
ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল
মাসের ৭ তারিখ শনিবার সকাল বেলা।[1] আর
আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দু’মাস
পূর্বে শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত
রাত্রে…!
এক্ষণে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলির ধর্মীয়
ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে দেখব। প্রথমটির
সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয় তা
নিম্নরূপ :
(১) এ রাতে কুরআন নাযিল হয় এবং এ রাতে
আগামী এক বছরের জন্য বান্দার ভালমন্দ
তাক্বদীর নির্ধারিত হয়।
(ক) প্রথমটির দলীল হিসাবে সূরা দুখান-এর ৩
ও ৪ আয়াত পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে আল্লাহ
বলেন, ﺎَّﻧِﺇ ُﻩﺎَﻨْﻟَﺰْﻧَﺍ ﻰِﻓ ٍﺔَﻠْﻴَﻟ ٍﺔَﻛَﺭﺎَﺒُﻣ
ﺎَّﻧِﺇ ﺎَّﻨُﻛ -َﻦْﻳِﺭِﺬْﻨُﻣ ﺎَﻬْﻴِﻓ ُﻕَﺮْﻔُﻳ ُّﻞُﻛ
ٍﻢْﻴِﻜَﺣٍﺮْﻣَﺃ- ‘আমরা এটি নাযিল করেছি এক
বরকতময় রাত্রিতে; আমরা তো সতর্ককারী’।
‘এ রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়
স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৪৪/৩-৪) ।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে
বলেন, ‘এখানে ‘বরকতময় রাত্রি’ অর্থ ‘ক্বদরের
রাত্রি’। যেমন আল্লাহ বলেন, ﺎَّﻧِﺇ ُﻩﺎَﻨْﻟَﺰْﻧَﺃ
ْﻰِﻓ ٍﺔَﻠْﻴَﻟ ِﺭْﺪَﻘْﻟﺍ ‘নিশ্চয়ই আমরা এটি
নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’ (ক্বদর
৯৭/১) । আর সেটি হ’ল রামাযান মাসে। যেমন
আল্লাহ বলেন, ُﺮْﻬَﺷ َﻥﺎَﻀَﻣَﺭ َﻝِﺰْﻧُﺃ ْﻯِﺬَّﻟﺍ ِﻪْﻴِﻓ
ُﻥﺁْﺮُﻘْﻟﺍ، ‘এই সেই রামাযান মাস যার মধ্যে
কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫) ।
এক্ষণে ঐ রাত্রিকে মধ্য শা‘বান বা শবেবরাত
বলে ইকরিমা প্রমুখ হ’তে যে কথা বলা হয়েছে,
তা সঙ্গত কারণেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই রাতে
এক শা‘বান হ’তে আরেক শা‘বান পর্যন্ত বান্দার
ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। এমনকি তার বিবাহ,
সন্তানাদী ও মৃত্যু নির্ধারিত হয়’ বলে যে
হাদীছ[2] প্রচারিত আছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ
এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী
হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন,
ক্বদরের রাতেই লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত
ভাগ্যলিপি হ’তে পৃথক করে আগামী এক বছরের
নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য
ঘটনাবলী যা সংঘটিত হবে, সেগুলি লেখক
ফেরেশতাগণের নিকটে প্রদান করা হয়।
এভাবেই বর্ণিত হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ বিন
ওমর, মুজাহিদ, আবু মালিক, যাহ্হাক প্রমুখ
সালাফে ছালেহীনের নিকট হ’তে’ (ঐ, তাফসীর
সূরা দুখান ৩-৪ আয়াত) ।
(খ) অতঃপর ‘তাক্বদীর’ সম্পর্কে পবিত্র
কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য হ’ল- ُّﻞُﻛَﻭ ٍﺀْﻰَﺷ
ُﻩْﻮُﻠَﻌَﻓ ﻰِﻓ -ِﺮُﺑُّﺰﻟﺍ ُّﻞُﻛَﻭ ٍﺮْﻴِﻐَﺻ ٍﺮْﻴِﺒَﻛﻭ
ٌﺮَﻄَﺘْﺴُﻣ ‘তাদের সমস্ত কার্যকলাপ রক্ষিত আছে
আমলনামায়’। ‘আছে ছোট ও বড় সবকিছুই
লিপিবদ্ধ’ (ক্বামার ৫৪/৫২-৫৩) -এর ব্যাখ্যা
হাদীছে এসেছে যে, ‘আসমান সমূহ ও যমীন
সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ
স্বীয় মাখলূক্বাতের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ
করেছেন।[3] এক্ষণে ‘শবেবরাতে প্রতিবছর
ভাগ্য নির্ধারিত হয়’ বলে যে ধারণা প্রচলিত
আছে, তার কোন ছহীহ ভিত্তি নেই।
(২) এ রাতে বান্দার গোনাহসমূহ মাফ করা হয়!
সেজন্য দিনে ছিয়াম পালন ও রাতে ইবাদত
করতে হয়। এ সম্পর্কে প্রধান যে তিনটি
দলীল দেওয়া হয়ে থাকে, তা নিম্নরূপ :
(ক) হযরত আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﺍَﺫِﺇ ْﺖَﻧﺎَﻛ
ُﺔَﻠْﻴَﻟ ِﻒْﺼِّﻨﻟﺍ ْﻦِﻣ َﻥﺎَﺒْﻌَﺷ ﺍﻮُﻣﻮُﻘَﻓ ﺎَﻬَﻠْﻴَﻟ
ﺍﻮُﻣﻮُﺻَﻭ ﺎَﻫَﺭﺎَﻬَﻧ ‘মধ্য শা‘বান এলে তোমরা
রাত্রিতে ইবাদত কর ও দিবসে ছিয়াম পালন
কর’ (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৮) । হাদীছটি মওযূ‘
বা জাল (যঈফাহ হা/২১৩২) । এর সনদে ‘ইবনু
আবী সাব্রাহ’ নামে একজন রাবী আছেন, যিনি
হাদীছ জালকারী। দ্বিতীয়তঃ হাদীছটি
ছহীহ হাদীছের বিরোধী হওয়ায়
অগ্রহণযোগ্য। কেননা একই মর্মে প্রসিদ্ধ
‘হাদীছে নুযূল’ যা ইবনু মাজাহর ৯৮ পৃষ্ঠায় মা
আয়েশা (রাঃ) হ’তে (হা/১৩৬৬) এবং বুখারী
শরীফের (মীরাট ছাপা ১৩২৮ হি.) ১৫৩, ৯৩৬
ও ১১১৬ পৃষ্ঠায় যথাক্রমে হাদীছ সংখ্যা
১১৪৫, ৬৩২১ ও ৭৪৯৪ এবং ‘কুতুবে সিত্তাহ’
সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে সর্বমোট ৩০ জন
ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।[4] সেখানে
‘মধ্য শা‘বানের রাত্রি’ না বলে ‘প্রতি
রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ’ বলা হয়েছে। অতএব
ছহীহ হাদীছ সমূহের বর্ণনানুযায়ী
আল্লাহপাক প্রতি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে
নিম্ন আকাশে অবতরণ করে বান্দাকে ফজরের
সময় পর্যন্ত উপরোক্ত আহবান সমূহ জানিয়ে
থাকেন- শুধুমাত্র নির্দিষ্টভাবে মধ্য
শা‘বানের একটি রাত্রিতে নয় বা ঐ দিন
সূর্যাস্তের পর থেকেও নয়।
উক্ত মর্মে প্রসিদ্ধ ছহীহ হাদীছটি হ’ল-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমাদের মহান
প্রতিপালক প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে
দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছ
কি কেউ প্রার্থনাকারী আমি তার প্রার্থনা
কবুল করব। আছ কি কেউ যাচ্ঞাকারী, আমি
তাকে তা প্রদান করব। আছ কি কেউ
ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?’
(বুখারী হা/১১৪৫) । একই রাবী হ’তে ছহীহ
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, যতক্ষণ না ফজর
প্রকাশিত হয়’ (মুসলিম হা/৭৫৮) ।
শবেবরাতের পক্ষে আরও কিছু যঈফ ও মওযূ‘
হাদীছ পেশ করা হয়। যেমন আয়েশা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯; মিশকাত
হা/১২৯৯), আবু উমামা (রাঃ ) হ’তে বর্ণিত
(যঈফাহ হা/১৪৫২), আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)
হ’তে বর্ণিত (ইবনু মাজাহ হা/১৩৯০; মিশকাত
হা/১৩০৬)। এতদ্ব্যতীত ইমরান বিন হুছাইন
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত ছহীহ মুসলিম হা/১১৬১-
এর ‘সিরারে শা‘বান’ সম্পর্কিত হাদীছটি বলা
হয়। যেটি ছিল মানতের ছিয়াম। তার সাথে
শবেবরাতের কোন সম্পর্ক নেই (মুসলিম, শরহ
নববী সহ) ।
(৩) এ রাতে রূহ সমূহের আগমন ঘটে
ধারণা প্রচলিত আছে যে, এ রাতে রূহগুলি সব
মর্ত্যে নেমে আসে। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি
রূহগুলি ইল্লীন বা সিজ্জীন হ’তে
সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে?
তারা কি স্ব স্ব বাড়ীতে বা কবরে ফিরে আসে?
যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে
কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি মেয়েদের
জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হ’লেও তাদেরকেও এ
রাতে কবরস্থানে ভিড় করতে দেখা যায়। এ
সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরা ক্বদর-এর ৪ ও ৫
আয়াত দু’টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হয়ে
থাকে। যেখানে বলা হয়েছে, ُﻝَّﺰَﻨَﺗ ُﺔَﻜِﺋﻶﻤْﻟﺍ
ُﺡْﻭُّﺮﻟﺍَﻭ ﺎَﻬْﻴِﻓ ِﻥْﺫﺈِﺑ ْﻢِﻬِّﺑَﺭ ْﻦِﻣ ِّﻞُﻛ ،ٍﺮْﻣَﺍ
،ٌﻡﻼَﺳ َﻰِﻫ ﻰَّﺘَﺣ ِﻊَﻠْﻄَﻣ ِﺮْﺠَﻔْﻟﺍ – ‘সে রাত্রিতে
ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের
প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে
কেবল শান্তি; ফজরের উদয়কাল পর্যন্ত’।
এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে লায়লাতুল ক্বদর বা
শবেক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই সূরার ১ম,
২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে এবং ‘রূহ’ বলতে
জিব্রীল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।
অত্র সূরায় ‘রূহ’ অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে
বিধায় হয়তবা অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে,
মৃত ব্যক্তিদের রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে
আসে। অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননি।
‘রূহ’ শব্দটি একবচন। এ সম্পর্কে হাফেয ইবনু
কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে
রূহ বলতে ফেরেশতাগণের সরদার জিবরাঈলকে
বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেন, বিশেষ ধরনের এক
ফেরেশতা। তবে এর কোন ছহীহ ভিত্তি নেই’
(ঐ, তাফসীর সূরা ক্বদর) ।
শা‘বান মাসের করণীয় : রামাযানের আগের মাস
হিসাবে শা‘বান মাসের প্রধান করণীয় হ’ল
অধিকহারে ছিয়াম পালন করা। মা আয়েশা (রাঃ)
বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রামাযান
ব্যতীত অন্য কোন মাসে শা‘বানের ন্যায় এত
অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। শেষের
দিকে তিনি মাত্র কয়েকটি দিন ছিয়াম ত্যাগ
করতেন’ (নাসাঈ হা/২১৭৯, সনদ ছহীহ) ।
যারা শা‘বানের প্রথম থেকে নিয়মিত ছিয়াম
পালন করেন, তাদের জন্য শেষের পনের দিন
ছিয়াম পালন করা উচিত নয়। অবশ্য যদি কেউ
অভ্যস্ত হন বা মানত করে থাকেন, তারা শেষের
দিকেও ছিয়াম পালন করবেন।
মোটকথা শা‘বান মাসে অধিক হারে নফল ছিয়াম
পালন করা সুন্নাত। ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন
দিন বা রাতকে ছিয়াম ও ইবাদতের জন্য
নির্দিষ্ট করা সুন্নাতের বরখেলাফ। অবশ্য
যারা ‘আইয়ামে বীয’-এর তিন দিন নফল
ছিয়ামে অভ্যস্ত, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ই শা‘বানে
উক্ত নিয়তেই ছিয়াম পালন করবেন,
শবেবরাতের নিয়তে নয়। নিয়তের গোলমাল
হ’লে কেবল কষ্ট করাই সার হবে। কেননা
বিদ‘আতী কোন আমল আল্লাহ পাক কবুল করেন না
এবং সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও
প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র
কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজ নিজ
আমল সমূহ পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার তাওফীক দান
করুন-আমীন!!
বিস্তারিত দ্র : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
প্রকাশিত ‘শবেবরাত’ বই।
[1]. লেখক প্রণীত সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩৩৯
পৃ.; অনেকে ১১ কিংবা ১৫ই শাওয়াল বলেছেন।
[2]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত
১৪০৭/১৯৮৭ : মিসরী ছাপা ১৩২৮ হি. থেকে
মুদ্রিত) ২৪/৬৫ পৃ. সূরা দুখান।
[3]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯
‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।
[4]. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম, মুখতাছার
ছাওয়াইকুল মুরসালাহ (রিয়ায : তাবি),
২/২৩০-৫০।

বিদআতিদের সাথে আচরণ কেমন করবেন??

বিদ’আতীগণ সুন্নাতের উপর আমল না করে নতুন
কিছুকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয় বলেই
তারা বিদ’আতী। বিদ’আতীরা কুরআন
এবং সহীহ হাদিসের অপব্যাখ্যা করেই
তাদের বিদ’আতটিকে জায়েয বলে জনগণের
নিকট চালিয়ে দিতে চায়। যেমন, প্রত্যেক
সুন্নাতের অনুসারীগণ জানেন যে, ইসলামে ৪
মাযহাব বলতে কিছুই নেই। এটা ৪০০
হিজরীতে বিদ’আতীদের আবিষ্কার। অথচ
বর্তমানে বিদ’আতীগণ মাযহাব মানার
পক্ষে কুরআন হাদীস থেকেই লেকচার দেয়।
প্রশ্ন হল, এই মাযহাবীগণ মাযহাব মানার
পক্ষে কুরআন হাদীসের কোথায় থেকে দলীল
পেল? অথচ তা রাসুলুল্লাহ ( ﻰﻠﺻ ﻪﻠﻟﺍ ﻪﻴﻠﻋ
ﻢﻠﺳﻭ), সাহাবা ( ﻲﺿﺭ ﻪّﻠﻟﺍ ﻪﻨﻋ )গণ পেলেন
না এবং এর উপর আমলও করলেন না। তাদের
দলীলগুলো বিশ্লেষন করলে বুঝা যায় যে,
তারা আল্লাহর আয়াত
সমূহকে অপব্যাখ্যা করে তাদের
বিদ’আতসমূহকে জায়েজ করার
অপচেষ্টা করে।
অনুরূপ অন্যান্য বিদ’আতের ক্ষেত্রেও
তারা আল্লাহর আয়াত
সমূহকে অপব্যাখ্যা করে যা আল্লাহ’র
আয়াতসমূহকে উপহাস/ঠাট্টা বিদ্রুপ করার
নামান্তর। কেননা, আল্লাহর আয়াত
সমূহকে যদি গুরুত্ব দেওয়া হত তবে কেউ এর
অপব্যাখ্যা করে বিদ’আতকে জায়েজ
বানানোর চেষ্টা করত না।
আল্লাহ বলেন : আর যখন তুমি তাদেরকে দেখ
আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক
সমালোচনার রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ
ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য
কথাবর্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান
তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর
যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসো না।
(সুরা আন’আম:৬৮)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন : আর
তিনি তো কিতাবে তোমাদের প্রতি নাযিল
করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর
আয়াতসমূহ অস্বীকার
করা হচ্ছে এবং সেগুলো নিয়ে উপহাস
করা হচ্ছে, তাহলে তোমরা তাদের
সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায়
নিবিষ্ট হয়, তা না হলে তোমরাও তাদের মত
হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুনাফিক ও
কাফিরদের
সকলকে জাহান্নামে একত্রকারী।
(সুরা নিসা:১৪০)
নিচের এই হাদীস দ্বারাও প্রমাণ হয় যে,
বিদ’আতীদের লেকচার শুনা যাবে না,
যেখানে বিদ’আতীরা দ্বীন
সম্পর্কে আলোচনা করছে সেখানে বসা যাবে
না। তাদের থেকে দ্বীন
শিক্ষা করা যাবে না। তাদের
থেকে দ্বীনের কোন তথ্যও নেওয়া যাবে না।
আবু হুরায়রাহ ( ﻲﺿﺭ ﻪّﻠﻟﺍ ﻪﻨﻋ ) বলেন,
রাসুলুল্লাহ ( ﻰﻠﺻ ﻪﻠﻟﺍ ﻢﻠﺳﻭ ﻪﻴﻠﻋ )
বলেছেন, শেষ যামানায় কিছু
মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব
ঘটবে তারা এমন কিছু হাদীস
বা কথা বার্তা বলবে যা না তোমরা শুনেছ,
না তোমাদের বাপ দাদারা কখনো শুনেছে।
সাবধান! তোমরা তাদের
থেকে দূরে থাকবে এবং তাদেরকে তোমাদে
র থেকে বিরত রাখবে,
যাতে তারা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট
করতে না পারে। আর না পারে কোন প্রকার
বিপর্যয়ে ফেলতে। (মুসলিম, মিশকাত ১ম
খন্ড, হা/১৪৭ ‘কিতাব ও
সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।)
সালাফগণ এর উপর আমল
করতে গিয়ে বিদ’আতীদের থেকে কোন
হাদীস গ্রহণ করতেন না। যেমন, মুহাম্মদ ইবনু
সিরীন বলেন, এক সময়ে মানুষ হাদীসের সূত্র
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না। যখন ফিতনা শুরু
হল অর্থাৎ যাছাই-বাছাই না করে মানুষ সত্য-
মিথ্যা বলা শুরু করল তখন শ্রোতারা বলল,
আপনারা সূত্র সহকারে বলুন।
যদি বর্ণনাকারীগণ সুন্নাতের অনুসারী হতেন,
তাহলে তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হত। আর
যদি বিদ’আতী হতেন, তাহলে তাদের হাদীছ
বর্জন করা হত। (মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ৪৬)

বিদ’আতি ইমামের পিছনে স্বালাত আদায় করা কখন যাবে এবং কখন যাবে না?

বিদ’আতী ইমামের পিছনে স্বালাত আদায়
করা কখন যাবে এবং কখন যাবে না?
সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্র জন্য।
এটি কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে…
১. বিদ’আতী ইমাম, সলাত ছাড়া অন্যান্য
স্থানে বিদ’আত করে:
বিদ’আতী ইমাম সলাতে কোন বিদ’আত করেন
না, কিন্তু সলাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত
ইত্যাদি করে থাকেন তবে তার পিছনে সলাত
আদায় করা যাবে।
২. বিদ’আতী ইমাম বড় শিরক্ করেন:
বিদ’আতী ইমামের
যদি শিরকী আকিদা থাকে, যেমন কোন
পীরের মুরিদ, তাবীয দেয়,
মিলাদে শিরকী কথা বলে, তবে এরূপ
ইমামের পিছনে সলাত আদায় করা যাবে না।
কেননা তিনি তাওহীদ বুঝেন না বা মানেন
না। ইমাম হওয়ার নুন্নতম সর্ত
হচ্ছে তাকে মুসলিম হতে হবে, শিরকে আকবর
বা বড় শিরক তার দ্বারা সংগঠিত হয়
বলে জানলে তার পিছনে সলাত আদায়
করা যাবে না। কারণ বড় শিরক্ যার
দ্বারা হয় তিনি মুসলিম নন, যতক্ষণ
না তিনি তাওবাহ্ করেন এবং সেই কাজ চির
দিনের জন্য ছেরে দেন।
৩. বিদ’আতী ইমাম সলাতে বিদ’আত করে:
ইমাম সলাতের মধ্যে যদি বিদ’আত করেন,
তাহলে আল্লাহ্র দরবারে সেই সলাত কবুল
হবে না। যেমন জানাযার সলাতে ইমাম
যদি সূরা ফাতিহা না পড়েন তবে সলাত
হবে না, যেহেতু সূরা ফাতিহা পড়া রুকুন
এবং কোন রুকুন যদি ছুটে যায় তবে সেই সলাত
প্রত্যাখ্যাত।
আমরা অনেকেই বলে থাকি মাযহাবীদের
পিছনে সলাত হবে না, এই কথাটি এক
অর্থে সত্য আবার সত্যও নয়। কেনন এমন অনেক
হানাফি ইমাম আছেন যাদের
আকীদাতে কোন ত্রুটি নেই, কিন্তু কোন এক
কারণে সে নিজেকে মাযহাবী বলে থাকে,
তবে এরূপ ব্যক্তির পিছনে সলাত হবে।
আমাদের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, ইমাম
শিরক্ করেন কি না এবং তিনি সলাতের
মধ্যে বিদ’আত করেন কিনা। যদি এরূপ
খুঁজে পাওয়া যায় তবে তার পিছনে সলাত
হবে না। অন্য কথায় যদি ইমাম এরূপ না করেন
তবে তার পিছনে সলাত আদায় করা যাবে।
কেননা জামাআতে সলাত আদায়
করা ওয়াজীব।
আল্লাহ্ আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন,
সালাম ও দরূদ বর্ষিত হোক মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু’আলাইহী’ওয়াসাল্লাম এর উপর,
তার পরিবার এবং সাথীদের উপর।